Thursday 8 September 2016

জিজিয়া নিয়ে মিথ্যাচার - এবং কিছু কথা



শেখ ফরিদ আলম

‘জিজিয়া’– ইসলামী রাষ্ট্রে বসবাসকারী অমুসলিমদের জন্য এমন এক ব্যবস্থা যা তাদের জান, মাল, ইজ্জত আব্রুর নিরাপত্তা করে।এই ব্যবস্থা এতটাই সুন্দর যে, যে কেউ নিরপেক্ষভাবে জিজিয়া সম্পর্কে জানবে সেই এতে মুগ্ধ না হয়ে পারবে না।জিজিয়া নিয়ে ইংরেজ ঐতিহাসিকদের মিথ্যাচারে পা দিয়ে অনেকেই এটাকে খুব খারাপ ব্যবস্থা এবং অমুসলিমদের উপর অত্যাচার বলে মেনে নিয়েছেন।এবং অনেকে এও মনে করেন যে জিজিয়া হল জবরদস্তি অমুসলিমদের মুসলিম করার জন্য। প্রসঙ্গত, ইসলাম গ্রহনে জবরদস্তি বা বলপ্রয়োগের কোন স্থান নেই। আল্লাহ বলেন, ‘ধর্মে বল প্রয়োগের কোনো স্থান নেই। সঠিক পথ প্রকৃতই ভুল পথ হতে পৃথক। যে শয়তানে অবিশ্বাসী এবং আল্লাহতে বিশ্বাসী সে বাস্তবিকই এমন এক মজবুত হাতল ধরবে যা কখনো ভাঙে না। আল্লাহ সবার কথা শোনেন। তিনি সবকিছুই জানেন’। (সুরা বাক্কারাহ/২৫৬) জিজিয়া নিয়ে কিছু বলার আগে গোয়েবলসের একটা বাণী শুনুন। তিনি বলেছেন, ‘একটা মিথ্যা কথা যদি বহুজনের কাছে বহুবার বলা যায় তাহলে সেটাই সত্যে পরিণত হয়ে যায়’।আর জিজিয়ার ব্যাপারটা নিয়েও ঠিক তাই হয়েছে ভারত তথা পাশ্চাত্যের দেশ গুলোতে।

জিজিয়া আসলে কী? জিজিয়া ইসলামী রাষ্ট্রের এক প্রকারের কর যা অমুসলিমদের দিতে হয়।কারণ, রাষ্ট্রে যে কোন বিপদ বা শত্রুর আক্রমণ, যুদ্ধ হলে মুসলিমদের জন্য তা জিহাদ।জিহাদে অংশগ্রহণ করা সকল সক্ষম মুসলমান নর-নারীর জন্য অত্যাবশ্যকীয়।কিন্তু বিধর্মীদের জন্য জিহাদ আবশ্যকীয় নয়, পরিবর্তে তারা রাষ্ট্রকে একটি কর দেবে যার নাম “জিজিয়া”।জিজিয়া’র শব্দগত অর্থ সামরিক কর্তব্য থেকে অব্যাহতিজনিত কর।এই কর দেওয়ার ফলে তারাও সেই নিরাপত্তা পাবে যা মুসলিমরা পায়।অর্থাৎ রাষ্ট্র মুসলিমদের পাশাপাশি জিম্মি অমুসলিমদেরও প্রাণ, সম্পদ, উপাসনালয়, ইজ্জত রক্ষা করবে।শুধু তাই নয়, মুসলিমদের যাকাত, ফেতরা, ফসলের ওশর, সদ্বকাহ ইত্যাদি দিয়ে হয় যা তাদের দিতে হবেনা।আর জিজিয়া ছিল খুবই সামান্য একটা কর। উমার রা. ধনীদের ক্ষেত্রে বার্ষিক আটচল্লিশ দেরহাম বা বারো টাকা, মধ্যবিত্তদের জন্য চব্বিশ দেরহাম বা ছ’টাকা এবং গরীবদের জন্য বারো দেরহাম বা তিনটাকা নির্ধারণ করেছিলেন’ (জিজিয়া প্রসঙ্গে; পৃ – ৩৬)।
জিজিয়া কর থেকে নারী, শিশু, বৃদ্ধ এবং ভিক্ষুকদের অব্যাহতি দেওয়া হতো। এই কর ছিল শুধুমাত্র সামরিক বাহিনীতে যোগদানে সক্ষম এবং আর্থিকভাবে স্বচ্ছল পুরুষদের জন্য। এন্সাইক্লোপেডিয়া ওব ইসলামে বলা হয়েছে, ‘The Zazia as a tax on the free from military service’. ঐতিহাসীক টি. ডব্লিউ. আর্নল্ড লিখেছেন, ‘ইসলামী সাম্রাজ্যে অমুসলিম প্রজাবৃন্দ মুসলিমদের রক্ষণাবেক্ষণ থেকে জিজিয়া কর প্রদান করত।আর এভাবে তারা সামরিক খেদমত ও তৎপরতা থেকে অব্যাহতি লাভ করত।অমুসলিম প্রজাবৃন্দ যদি সৈন্যবাহিনীতে যোগদান করত তাহলে তাদের জন্যও জিজিয়া কর রহিত করা হতো।পক্ষান্তরে মিশরীয় মুসলিম কৃষকদের যখন সৈন্য বিভাগে যোগদান থেকে নিষ্কৃতি দেওয়া হল তখন কিন্তু তাদের উপর খ্রীষ্টান অধিবাসীদের মতোই এই কর ধার্য করা হয়েছিল’। [The Preaching of Islam; P-63] কাউন্ট হেনরি বলেছেন, ‘ইসলামের নীতি ছিল এই যে, যারা ইসলাম ধর্ম গ্রহন করত, তাদের ধন-প্রাণ এবং সন্মানের হেফাজত করা হতো।কিন্তু যারা নিজেদের পৈত্রিক ধর্মে থাকতে চাইত তাদের উপর জিজিয়া নামে এক মামুলি কর চাপিয়ে এরুপ ব্যবহার করা হতো, যেরুপ মুসলিমদের প্রতি করা উচিত।আর ধর্মীয় ব্যাপারেও তাদের ওপর কোন বলপ্রয়োগ করা হতো না’। [আওরঙ্গজেবঃ ধর্মনিরপেক্ষতা ও ইসলাম; ১৭০ পৃষ্ঠা]

ভারতে জিজিয়া শব্দের পরেই যে নামটি   উচ্চারিত এবং সমালোচিত হয় তিনি হলেন ‘আওরঙ্গজেব’। সুলতানী আমলে জিজিয়া কর ছিল, আকবর তা বন্ধ করে দেন। পরে আওরঙ্গজেব জিজিয়া পুনর্বলবৎ করেন। আবার হিন্দুদের উপর জিজিয়া কর লাগু করার কারণে তিনি অনেক সমালোচিত হয়ে আসছেন। অনেকেই তাঁকে হিন্দু বিদ্বেষী বলে থাকেন। কিন্তু মজার ব্যাপার হল, আওরঙ্গজেব হিন্দুদের উপর থেকে প্রায় ৮০ টি কর তুলে দিয়েছিলেন। স্যার যদুনাথ সরকার তাঁর Mughal Administration পুস্তকের পঞ্চম অধ্যায়ে ৬৫ করের কথা উল্লেখ করেছেন। A Vindication of Aurangzib বইয়ের ১৩০ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে – ‘When Aurangzib abolished about eighty taxes, no one thanked for his generosity, but when he imposed only one tax, no heavy at all, people began to show their displeasure’.

 শেষ করার আগে বলব, মিথ্যা কখনও জিতবে না। মিথ্যার জয় সাময়িক হতে পারে তবে শেষ হাসিটা সবসময় সত্যেরই হয়। সত্যকে বেশি দিন ধামাচাপা দিয়েও রাখা সম্ভব নয়। সত্য তার নিজ বৈশিষ্টেই প্রকাশ হয়ে যাবে। আর তাই ঔডিষ্যার প্রাক্তন রাজ্যপাল বি.এন পান্ডে, ঐতিহাসীক তপন রায় চৌধুরি, ইশ্বরদাস, গৌতম রায়, শ্যামল চক্রবর্তী এবং আরো অনেকেই আওরঙ্গজেব, জিজিয়া, বলপ্রয়োগ করে ইসলাম গ্রহন প্রভৃতি বিষয়ে সত্য প্রচার করে চলেছেন।

No comments:

Post a Comment